সব গল্পের শেষ সুন্দর হয় না ।

ভালোবাসা-সম্পর্ক-শুভ পরিণয়, কিন্তু তারপর ? যেদিক থেকে কাঁচকে স্বচ্ছ লাগে, ঠিক তার উল্টো দিকেই থাকে লাল প্রলেপ।

Originally published in bn
Reactions 0
581
Sayan Mistri
Sayan Mistri 10 Dec, 2020 | 1 min read

- "ঠিক করে ভেবে দেখুন, আপনি কিন্তু স্বীকার করে নিচ্ছেন..."

- "হ্যাঁ আমি স্বীকার করছি, খুন আমিই করেছি। সম্পূর্ণ সজ্ঞানে সুপরিকল্পিত ভাবে সেদিন রাতে খুনটা আমিই করেছি।"

- জজসাহেবের অসম্পূর্ণ কথার রেশ টেনে একদমে কথা গুলো বলে গেল অর্কদীপ রায় ।


"অর্কদীপ রায়" , বয়স বছর ঊনত্রিশেক হবে, বালিগঞ্জের কাছে গোলপার্কে পৈতৃক পুরানো বাড়িতে থাকেন, সিটি কলেজের ইংরেজির তরুণ অধ্যাপক, ভালো সেতার বাজান, কলকাতা থিয়েটারেও বেশ পরিচিত মুখ। কিন্তু এসবের পাশেও, তার আরও একটি পরিচয় আছে,

 - তিনি আমার গল্পের নায়কও বটে। 

কিন্তু সমস্যা হলো আমার নায়ক এক খলনায়কোচিত কাজ করে চৈত্রের এই ভ্যাপসা গরমে নিজের এ.সি. স্টাফ রুম ছেড়ে কলকাতা হাইকোর্টের এই বিচার ঘরের ৫ বাই ৫ সাইজের আসামী বক্সে দাঁড়িয়ে আছেন। 


কেন ??? 

- আচ্ছা বেশ, চলুন তবে দেখি ---

এই যে অর্কের এতগুলো গুণের কথা বললাম, তার মধ্যে আরেকটি হলো, " ও বেশ ভালো প্রেমিকও কিন্তু ।"

 সেই কলেজের নবীণবরণের দিন থেকে শুরু করে ও লাবণ্যকে নিয়ে নয় নয় করে দশটা বসন্ত কাটিয়ে দিয়েছে।

তারপর....?

তারপর আর পাঁচটা লাভ স্টোরির মতো চাকরির পর বিয়ে, হানিমুন সবই হলো । সমস্যার শুরু বিয়ের একবছর পর।


 এক শীতের সন্ধ্যায়, অর্ক লাবণ্যকে নিয়ে যায় বেহালায় কলিগ সুমন্তের অ্যানিভার্সারিতে । 


সেখানেই লাবণ্যের আলাপ হয় শহ‍রের উঠতি তরুণ ব্যাবসায়ী রাজশেখর দত্তের সঙ্গে। 

হ্যাঁ, মানছি আমার নায়িকা আর পাঁচটা নায়িকার মতো অপরূপা সুন্দরী নন, তবে তার সারল্য আর মায়াবী চোখের চাহনিতে কত উঠতি যুবকের রাতের ঘুম নষ্ট হয়েছে, তার ইয়ত্তা নেই। --- অপরদিকে রাজশেখরের রাজকীয় ব্যাক্তিত্ব , গলার গম্ভীর স্বর, স্বল্পভাষী মিষ্টি ব্যবহার, আর চোখের কোণার ঐ জ্বলজ্বলে লাল তিলটা, 

- নাহ, লাবণ্য কেন, যে কোনো মহিলার পক্ষেই নিজেকে আটকানো বেশ কষ্টকর ব্যাপার ।

 আর কেবল লাবণ্য নয় , ব্যাক্তিত্বের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে প্রথম সাক্ষাৎএ অর্ক নিজেই রাজশেখরকে দুম করে ডিনারের আমন্ত্রণ করে বসলেন।

 

- তিনি এলেনও । দিন তিনেক পর এক মৃদু বর্ষামুখর সন্ধ্যায় তিনি এলেন। সঙ্গে একগুচ্ছ লাল হলুদ গোলাপ, রেড ওয়াইন আর সম্পর্ক ভাঙ্গার এক কালো ইঙ্গিত।  

সন্ধ্যাটা, লাবণ্যের হাতের রান্না, কান্ট্রি মিউজিক, অর্কের সেতারে জমেওছিল ভালো। শুধু রাজশেখর সেদিন কোনো ভাবেই লাবণ্যের কালো শাড়ি ও টিপ পরিহিত শরীরটা থেকে চোখদুটোকে ফেরাতে পারছিল না। আর তাতে যোগ্য সঙ্গতও দিচ্ছিল লাবণ্যের প্রশয়।


  ব্যাস্। এভাবেই সূত্রপাত শহরের আরও একটা বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্কের, যাকে আমাদের নাগরিক সমাজ "অ"বৈধ" ট্যাগ লাগিয়ে খুব সাবধানে এড়িয়ে চলে। 

তারপর ??? তারপর আর কি ...?

 - তারপর সেই অবৈধ সম্পর্ক ক্রমেই হয়ে ওঠে অপবিত্র, অশালীন এবং "অ"নিয়ন্ত্রিত," যার সাক্ষী থেকে যায় শহরের মধ্যদুপুরের কত পার্ক, লেক, ক্যাফেটেরিয়া বা সিনেমাহল ।

 

--- কিন্তু ওহে বঙ্গসমাজ, তুমি কি করে জানবে, নিষিদ্ধতাতেই যে কৌতুহলের বাস । পৃথিবীর সমস্ত রহস্য-রোমাঞ্চতো ঐ নিষিদ্ধতার নিগূঢ় আঁধারেই লুকিয়ে থাকে। 

- হ্যাঁ, সেই রোমাঞ্চ তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগও করেছিল রাজশেখর আর লাবণ্য । 


 অপরাধবোধেও লাবণ্য ভুগত , কিন্তু নায়ক যে আমার বড়ই সাদাসিধে লোক, নইলে এই মাল্টিপ্লেক্সের যুগে এখনো কেউ থিয়েটারে পড়ে থাকে !!!

  বিয়ের পরপরই লাবণ্য বুঝেছিল,আসলে ভালোবাসার জন্য অর্ক যেন বড্ড বেশিই নিখুঁত।

 ওরকম লোককে শ্রদ্ধা করা যায়, কিন্তু বিয়েটা বাড়াবাড়ি হয়ে যায়। তাই আর পিছু ফেরা হয়নি লাবণ্যের , ভাসিয়ে দিয়েছিল ও নিজেকে কোনো অজানা পরিণতির উদ্দেশ্যে । 


 সন্দেহটা হয় লাবণ্যের পার্সে রাজশেখরের অফিসের ভিজিটিং কার্ড দেখে ।

অর্ক সরাসরি লাবণ্যকে জিঙ্গাসা করতেই লাবণ্য আমতা আমতা করে এড়িয়ে যায় ।

ঐ যে বললাম না যেখানেই নিষিদ্ধতার গন্ধ সেখানেই কৌতুহলের ভিড়। 

   সন্দেহটা আরও দৃঢ় হলো, রাতের ঘুম উড়লো, কলেজের জন্য বেড়িয়েও নিজের সবথেকে চেনা প্রিয় বিশ্বস্ত মানুষটার পিছুও নিতে হলো।

  ওদের দুজনকে সেদিন ওভাবে দেখে দাবানলের সদ্য জ্বলে ওঠা আগুনের মতো অর্কর বুকটাও জ্বলে উঠেছিল। এ অনুভূতির সাথে হয়তো অনেক পাঠকই সুপরিচিত। মেনে নিয়ে ফিরে এসেছিল ।


 একদম চুপ মেরে যাওয়া অর্ক আরও কিছু দিন কাটালো অবিশ্বাসের ভিতের ওপর আর মিথ্যে সম্পর্কের ছাদের তলায়। কেমন যেন নিজের মধ্যে নিজেকে গোটাতে শুরু করলো অর্ক । গোটা কয়েক বন্ধু যা বা ছিল তাদের সাথেও যোগাযোগ কমলো । লাবণ্য ছাড়া সাতকুলে কেউ ছিল কিনা তা ও নিজেও জানতো না। 

 দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া অর্কও একদিন রাতের অন্ধকারে ছাদে গিয়ে চেঁচিয়ে উঠে জানতে চেয়েছিল কেন ওর সাথেই হলো, সেদিন আকাশটাও যেন চুপ করে ওর ছেলেমানুষী দেখে মুচকি হাসছিল। খুব রাগ হয়েছিল অর্কর। 

  

পরেরদিন কলেজ না গিয়ে ও ঢুকলো এক বারে, সারাটাদিন গলা অবধি মদ গিলে রাতে শহরের হলুদ ল্যাম্পপোস্টের আলোয় ও ঘরে ফিরল । 


  ঘুমিয়ে পড়েছিল লাবণ্য। নীল নাইট বাল্বের আলোয় ঘর উদ্ভাসিত। আর সেই মোহময়ী নীল আলোয় আরও লালিত্য ঠিকরে বেরোচ্ছিল লাবণ্যের শরীর থেকে। কিন্তু আজ অর্ক দৃঢ়প্রতিজ্ঞ‌।

 

 ব্যাগের চেনটা খুলে ও বের করে আনলো নিউ মার্কেটের দোকান থেকে কেনা ভারী ইস্পাতের অস্ত্রটা, মাঝারি সাইজ, একদিকে কুমিরের দাঁতের মতো খাঁজকাটা, অসাধারণ জিনিস। প্রথম দেখাতেই পছন্দ হয়েছিল অর্কর। এইরকমটাই তো সে খুঁজছিল।

 রীতিমতো ইন্টারনেট ঘেঁটে অর্কর মনে হয়েছিল হাতের কাছে পাওয়া উপায় গুলোর মধ্যে এটাই সবথেকে "পেইনলেস।" ঘুমের মধ্যে আচমকা গলার নলির ওপর দিয়ে একবার চালিয়ে দিলেই .........


 --- কাঁপা কাঁপা হাতে দিয়েওছিল অর্ক চালিয়ে । । হাত পায়ের আঙুলগুলো পাকিয়ে বারবার বিছানায় ছুঁড়ছিল লাবণ্য। যেন আত্মসমর্পণের সুযোগ না দেওয়ায় অর্কর প্রতি রাগের মিথ্যে আস্ফালন । শরীরটা বার কয়েক মুচড়ে ছটফটিয়ে উঠে শান্ত হয়ে গেছিল । "ক্যাডাভেরিক স্পাসম্"।

 বেশ ভয় পেয়েছিল অর্ক । জীবনে প্রথমবার মৃত্যু দেখেছিল অর্ক । এতটাও প্রস্তুতি ওর ছিল না । সারাটা রাত লাবণ্যের নিথর দেহটা কোলে নিয়ে বসেছিল ও । সকালে নিজেই পুলিশে ফোন করে খবর দেয় । খুনটা রাগের মাথায় করলেও অর্ক জানতো মিথ্যে বলা, অস্বীকার করা, অ্যালিবাই তৈরী, ইন্টেরোগেশন, ট্রায়ালের পর ট্রায়াল এসব ওর দ্বারা সম্ভব না ।

 

 আর সবথেকে বড়ো কথা কার থেকে পালাবে ও ? 

"ভালোবাসার কাছে হেরেছে, এবার কি নিজের বিবেকের কাছে হারতো ?"


....... ধুর আর পাঁচটা গড়পড়তা গল্পের মতোই হয়ে যাচ্ছে, শেষ করতে হবে এবার.... 

 

 কোর্টেই ফিরছি ... 


"এতোই যদি ভালোবাসতেন তবে মারলেন কেন ?" --- জজসাহেবের অতর্কিত প্রশ্নে হুঁশ ফিরল অর্কর।


" ভালোবাসতাম বলেই , কষ্ট হতো ওকে মিথ্যে বলতে দেখে , জানেন ঠিক করে গুছিয়ে মিথ্যেটাও বলতে পারতো না, আমি সবটাই বুঝতাম কিন্তু ও আমাকে ঠিক করে বোঝাতে পারতো না, হাসিও পেত, কষ্টও হতো।"

কিছুক্ষণ দম নিয়ে থেমে থেমে অর্ক আবার বলতে শুরু করলো, " জানেন, আমি বুঝতে পারতাম, সারাক্ষণ ওর মধ্যে এক মানসিক দ্ধন্দ চলছে। ও যেন এক কঠিন দোটানায় পড়ে গেছে, আমার থেকে কেমন যেন পালিয়ে পালিয়ে বেড়াত।

 আমি জানতাম ও চাইলেও এখান থেকে আর বেরোতে পারবে না, ওর দিকে তাকাতেও কেমন অপরাধী মনে হতো নিজেকে।


এর থেকে ওর মুক্তি দরকার ছিল, নইলে যে ও দগ্ধে দগ্ধে মরতো, তাই....." - শেষ করতে পারলো না অর্ক ।


তারপর উপরের দিকে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে উঠল, 

" জজসাহেব, আপনার সাথে না হলে আপনিও বুঝবেন না ।"


----- কথাটা শুনেই বুকটা ছ্যাঁৎ করে উঠল মধ্যবয়স্ক জজসাহেবের। কাল রাতে তার স্ত্রী তাকে ফোন করে জানিয়ে দিয়েছিল, 

রাত্রে সে যাদবপুরে মায়ের কাছে থেকে যাবে।


 অথচ সকালে ফোন করে তিনি জানতে পারেন, রাত্রে তার স্ত্রী শ্বাশুড়ীর কাছে যাননি।


 আর হ্যাঁ, ওরকম একটা অচেনা লোকের ভিজিটিং কার্ড তিনিও তার স্ত্রীর ব্যাগে পেয়েছিলেন।


  


""""""জজসাহেব সব বোঝেন"""""""""

-----------------------------------------------------------------------

 


  


  অস্বীকার আপনি করতে পারবেন না, একটু চোখ কান বন্ধ খোলা রাখলে , শহরের এ প্রান্ত ও প্রান্তে এমন সম্পর্ক আপনি অনেক দেখেছেন।

    আর পরদিন সকালে এরকমই লাবণ্যদের মৃত্যু সংবাদও পেপারে পড়েছেন। 


  হ্যাঁ, এরকম সম্পর্কগুলোই তছনছ করে দেয় এরকম অনেক অর্ক-লাবণ্যের জীবন বা কোনো কোনো ক্ষেত্রে পরবর্তী প্রজন্মের ভবিষ্যতকেও।


  আপনি বলতেই পারেন তুমি ভাই চোখ কান বন্ধ রেখে চললেই পারো । 

... কিন্তু দাদা, সেটাই কি সমস্যার সমাধান ?


 তা ঠিক, দোষটা তো আমারই, আমি দেখে ফেলেছি যে। কিন্তু বলছি, আমি চোখ কান বন্ধ রাখলে মেয়ে টা বেঁচে যেত তো ! 

ছেলেটাও ছাড়া পেয়ে যেত নিশ্চয় !!! 

 

সুতরাং, এটা বড়ো কথা নয়, ... যে আমি কি করছি, বরং সমস্যার সমাধানে আপনি কতটা এগিয়ে এলেন সেটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ । 

 


অতি সামান্য মানুষ আমি, সমস্যাটুকুই তুলে ধরতে পারলাম,  


...... সমাধান ??? 


... সেটা আপনার ওপরই ছেড়ে দিলাম ।

0 likes

Published By

Sayan Mistri

sayanmistri

Comments

Appreciate the author by telling what you feel about the post 💓

Please Login or Create a free account to comment.